বাংলাদেশে ডাক্তারদের সেবা নামক ফিস বাণিজ্য
দূর্ভোগ পোহাচ্ছে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষ
বাংলাদেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে ডাক্তারদের ভিজিট বা ফিস। শরীরে রোগ-ব্যাধি দেখা দিলে আমরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। আর সেই ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ওষুধ সেবন করে ও উপদেশ মেনে চলে আমরা সুস্থ হয়ে উঠি। সপ্তাহ বা মাস যেতে না যেতেই বেড়ে চলেছে ডাক্তারদের ফিস বাণিজ্য। এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষ। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ ডাক্তারের ভিজিট বা ফি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু ডাক্তারদের অতিরিক্ত ফি গ্রহণ নিয়ে জনসাধারণ আজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যেখানে ডাক্তাররা ভালোভাবে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে ১৫ থেকে ২০টি রোগী দেখবেন, সেখানে তারা কম সময় দিয়ে ১০০টিরও বেশি রোগী দেখছেন। আবার অতিরিক্ত হারে ফি নিচ্ছেন।
ডাক্তারদের ফি নিয়ে সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এমবিবিএস ডিগ্রিধারী ডাক্তার ফি নিচ্ছেন ৪০০ টাকা। কিছু ডাক্তার বিশেষজ্ঞ না হয়েও ফি নিচ্ছেন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এফসিপিএস ডিগ্রিধারী অনেক ডাক্তার ফি নিচ্ছেন ১ হাজার থেকে ১৫’শ টাকা, যা অতিরিক্ত। এতে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট দেখাতে গেলে সেক্ষেত্রেও ডাক্তাররা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ফি নেন। এটা রোগীদের ওপর এক ধরনের জুলুম বৈকি। এতে রোগীরা দুর্ভোগে পড়ছেন। ডাক্তারদের চেম্বারে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ভিজিট নেবার পরও রোগীদের যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়না বলে অভিযোগ করেন অনেক রোগী। কিছু কিছু ব্যস্ত ডাক্তারগণ রোগীর সমস্যার কথা ভাল করে শোনার সময়ও পায়না।
সাম্প্রতি দেখা যায় ঢাকা বারডেম হাসপাতালের প্রফেসর ও প্রধান নিউরোমেডিসিন মেডিকেল অফিসার ডা. আমিরুল হক যিনি ডায়াবেটিকস ও নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ তার প্রাইভেট চেম্বারের দরজায় রোগী দেখার সময় ও সময়ের ভিত্তিতে রোগীর ভিজিট ফি নির্ধারিত করে লিখে টানিয়ে রেখেছেন। সেখানে দেখা যায়, তার প্রথম ভিজিট ১৫’শ টাকা, ৭দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেখালে ৫০০টাকা, ৭দিন পর দেখালে ১ হাজার টাকা আর ১মাস পর দেখালে পূনরায় ১৫’শ টাকা ভিজিট দিতে হবে। আজ থেকে ৫ বা ১০ বছর আগে ডাক্তারদের ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট দেখাতে ১ টাকাও লাগত না। এখন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ছাড়া কোনো রিপোর্টই দেখেন না। এভাবেই চলছে দেশে ডাক্তারদের সেবা নামক বাণিজ্য। শারীরিকভাবে অসুস্থ্য হলে সকলে ভাল চিকিৎসার জন্য ভাল চিকিৎসকের কাছে যেতে চান। কিন্তু নিন্ম আয়ের লোকজনের কাছে তা সম্ভব হয় না। কারন ওসব চিকিৎসকের কাছে যেতে হলে লাগবে ৫শ টাকা পরার্মশ ফি। এই ফি ছাড়াও রয়েছে রোগীর বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা ও ঔষধের খরচ। তাই অনেকে ঝুঁকছে হাতুড়ি ডাক্তারের দিকে। যেখানে গিয়ে তারা রোগের ধরন বলে। আর অনভিজ্ঞ ঔষধ বিক্রেতা ব্যবসার জন্য গতানুগতিক কিছু ঔষধ ধরিয়ে দেয়। এতে বেশিরভাগ সময় রোগের সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রোগী সাধারন। পরে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে ওই ৫শ টাকা ফি দিয়ে চিকিৎসক দেখাতে হয়। এর বাহিরে রয়েছে রোগের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা খরচ। এতে আর্থিকভাবে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় নিম্ন আয়ের লোকজন। মানুষের জীবনে রোগ-শোক-জরা-ব্যাধি-মৃত্যু-হারানো থাকবেই... কিন্তু সবকিছু থেকে বড় হলো ‘বেচেঁ থাকা’।
প্রভাবশালী, সম্পদশালীরা বাধ্য না হলে সরকারি হাসপাতালে আসে না। তারা বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নেন। এদেশের চিকিৎসাসেবায় তাদের আস্থা নেই। এ ছাড়া তাদের জন্য অত্যাধুনিক প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ইত্যাদি তো রয়েছেই। সরকারি অফিসে চলে তাদের শুধু হাজিরা, বাদবাকি প্রাইভেট প্রাকটিস। এর একমাত্র কারণ কোথাও জবাবদিহিতা নেই। কাউকে কোথাও বদলি করলে রাজনৈতিক তদবির তো আছেই। ঘুরেফিরে বহাল তবিয়তেই থাকেন তারা। এত আরাম, অর্থ, বিত্ত, প্রভাব ডাক্তারদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। ডাক্তারদের অবহেলার কারণে দেশের বিশাল অঙ্কের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। কোনো রোগী তার রোগ নিরাময়ে বা কষ্ট লাঘবের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে প্রথমেই তাকে অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত অর্থ ফি প্রদান করতে হয়। দেশে সর্বোচ্চ আমলা একজন সচিবের মাসিক বেতন ৪০,০০০ টাকা হিসেবে দৈনিক এক হাজারের কিছু বেশী। একই দেশে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার নিয়মিত চাকরির পর সন্ধ্যায় রোগী দেখে প্রতিদিন কমবেশি অতিরিক্ত ১০,০০০ টাকা ফি আদায় করেন। এটা জনপ্রতি ৫০০ টাকা হারে ২০ জন রোগীর কাছ থেকে দৈনিক আদায়। অনেকে ২০ জনেরও বেশি রোগী দেখে থাকেন। বাংলাদেশে মানুষের যে আয় তাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ আয়ের পরিমান বিবেচনা করলেও জনপ্রতি রোগী থেকে ১০০ টাকার বেশি নেয়া অযৌক্তিক। চিকিৎসক তো মুনাফালোভী ব্যবসায়ী নন। অতিরিক্ত আয় যাদের জীবনের লক্ষ্য তাদের চিকিৎসা সেবা পেশায় না আসাই উচিত। এছাড়া বাংলাদেশে দ্য মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজিষ্ট্রেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২ নামে একটি আইন আছে। যাতে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রাকটিসের ক্ষেত্রে এবং প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপন ও পরিচালনায় সুষ্পষ্ট নিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী কোনো সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত আছেন, এমন কোনো রেজিষ্টার্ড চিকিৎসক অফিস চলাকালীন কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা নার্সিং হোমে প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন না এবং করলে তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। রোগীদের কাছ থেকে কী পরিমাণ ফি নির্ধারণ করা হবে, তা এ আইনে উল্লেখ আছে, যা সচরাচর মানা হয় না। সরকার চিকিৎসকদের পরামর্শ দিলে বা সতর্ক করলে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।
রোগীর জীবন রক্ষার ও সেবাদানে চিকিৎসকের পবিত্র দায়িত্ব এবং এ দায়িত্বের পবিত্রতা রক্ষার দায়দায়িত্ব কেবল চিকিৎসককেই পালন করতে হবে কর্তব্যপরায়ণতার মাধ্যমে, অবহেলার মাধ্যমে নয়। রোগী চিকিৎসকের ওপরে চূড়ান্ত আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন, যা সর্বতোভাবেই নির্ভেজাল। একজন চিকিৎসককে রোগীর এই আস্থাকে গভীর মমত্ববোধের সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে এবং সেই মোতাবেক চিকিৎসা সেবাদানে ব্রতী হতে হবে। ইদানীং পট কোম্পানি বলে কিছু ভূঁইফোড় কোম্পানি বেরিয়েছে। যারা ডাক্তারদের সাথে মাসোহারা চুক্তি করে মানহীন ক্যালসিয়াম বা ভিটামিন ট্যাবলেট লিখে থাকেন। এক পটের দাম দেড়শ থেকে তিনশত টাকা পর্যন্ত! এই মানহীন বেনামি কোম্পানির ঔষধ লিখে ডাক্তারগণ কিছু কামিয়ে নিলেও ভুক্তভোগি রোগী নিরবে প্রতারিত হয়। উচ্চ শিক্ষিত এই সব মানুষদের কাছে সমাজ যা কখনোই প্রত্যাশা করে না। এছাড়াও নামি কোম্পানি গুলিও নানান অসাধু প্রতিযোগিতা করছে। তারা মেডিসিনের দাম বাড়াচ্ছে অযৌক্তিক হারে। এছাড়াও প্রতি বছর বাজেটে স্বাস্থ্যসেবার জন্য যে বরাদ্দ সরকার রাখে, তার অর্ধেকও জনগণের কল্যাণে ব্যায় হয় না। একজন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি পীড়িতাবস্থায় তাঁর আশ্রয়ের সর্বশেষ স্থল হিসেবে একজন চিকিৎসকের কাছে যান এই আশায় যে, তাঁর চিকিৎসক প্রাণনাশী রোগের আক্রমণের বিরুদ্ধে সম্ভব সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাঁকে সারিয়ে তুলবেন এবং বাঁচিয়ে রাখবেন।
তবে এত কিছুর পরও সমাজে সব ডাক্তারই অর্থের পেছনে ছুটছে এটা বলা অন্যায়। অনেক ভাল মনের ডাক্তার রয়েছে যারা দুস্থদের বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন। আবার অনেক ভালো চিকিসাকেন্দ্র আছে যারা প্রকৃতই সেবা প্রদান করে থাকে। টাকা নয় তারা মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে কাজ করেন। যারা রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য তাদের সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে থাকেন।
সরকারী হাসপাতালের বেতন ভুক্ত ডাক্তারগণ নিয়মিত অফিসে আসেন না। আর সরকারী ঔষুধও ঠিক মত বন্টন করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারী হাসপাতাল গুলির নানা অনিয়ম ও নাজুক অবস্থা নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন পত্রিকা আর স্যাটেলাইট চ্যানেলে নিউজ হয়। কিন্তু তাতে বিশেষ কোন উন্নতি চোখে পড়েনি। চিকিৎসকদের কাছে দেশের মানুষ জানতে চায়, দেশে চিকিৎসাসেবার নামে যা চলছে তা কি চলতে দেয়া যায় ?
লেখক : সাব্বির আহমেদ (সাংবাদিক ও কলামিষ্ট)


কোন মন্তব্য নেই