বাংলাদেশে ৬ বছরে ১৩ শতাধিক শিশু ধর্ষিত
বাংলাদেশে কঠোর আইন ও সচেতনতা বৃৃদ্ধি সত্ত্বেও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশুরা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। শিশু ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পর হত্যার এ চিত্র দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। ঘরে কিংবা বাইরে, শহরে কিংবা গ্রামে সবখানেই ঘটছে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা। বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণ মূলত নির্যাতন করার পরও আইনের আওতায় আসছে না অপরাধী। ফলে একের পর এক শিশু ধর্ষণের মতো পৈশাচিক ঘটনা ঘটছে। আইন থাকলেও তা উপেক্ষিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত মামলা হলে যে চার্জশিট দেওয়া হয় তাতে আইনের ফাঁক-ফোকর থাকে। নির্যাতিত শিশু দরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত আর অপরাধী ক্ষমতাবান প্রভাবশালী হওয়ার ফলে মামলা তার গতি হারায়। শিশুর পক্ষে সাক্ষী-সাবুদ পাওয়া যায় না। দরিদ্র অভিভাবক অনেক সময় অল্প টাকায় আসামির সাথে আপস করে মামলা তুলে নেয়। অনেকে আবার ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলেও সম্মান খোয়ানোর ভয়ে মামলা করে না। আবার মামলা করলেও আসামি পক্ষের আইনজীবির নোংরা জেরা এবং দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চলানোর কারণে বাদী পক্ষের মামলা চালিয়ে নেওয়াও সম্ভব হয় না। ফলে সমাজে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলেছে। শিশু নির্যাতনের মামলাগুলোর দ্রুত বিচার করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে এ ধরনের ঘটনা হ্রাস পাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে যথাক্রমে ৮৬ ও ১৭০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৪ সালে ১৯৯ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যাদের মধ্যে ২২টি শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, ২১টি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ২৩টি শিশু ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যাদের মধ্যে ৯৯ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়, ৩০ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং ৪ জন শিশু ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। চলতি বছরে অর্থাৎ ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩২৫টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই ৩২৫ শিশুর মধ্যে ৪৮ জন শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৩১ জন প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশু ও ৫ জন গৃহকর্মী শিশু ধর্ষিত হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫ জন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৫৪ শিশুকে। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে ৩৫টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। যা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা।
পরিসংখ্যান বলছে : ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ৬ বছরে মোট ১৩'শ ১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৬৯ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯৩ জন, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ৩২ জন শিশু এবং ধর্ষণের চেষ্টা করেছে ১৬৫ জন শিশুকে। এ বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে মাসওয়ারি পরিসংখ্যানে ধর্ষণের শিকার দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে ৩৩, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৪, মার্চে ২৯, এপ্রিলে ৪২, মে মাসে ৪৪, জুনে ৩৯, জুলাইয়ে ৩৩, আগস্টে ৩৭ এবং সেপ্টেম্বরে ৩৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে ৩৭টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই সময়ে মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ১৫টি শিশু। অর্থাৎ প্রতি দুই মাসে একজন শিশু ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। এছাড়াও ইভটিজিং, শ্লীলতাহানী, যৌন হয়রানি, মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে আরো ৭৮ শিশু। শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে তারা বলছে, ৫ বছরের শিশু থেকে ১৮ বছরের শিশু কেউই ঝুঁকিমুক্ত নয়। ধর্ষিত শিশুদের অধিকাংশের বয়সই ৫-১২ এর মধ্যে। এদের নানা কৌশলে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ৫-১২ বছরের শিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে চকলেট, খেলনা বা কোনো শৌখিন জিনিস দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এবং কোনো নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে। ১৩-১৮ বছরের শিশুদের ধর্ষণ করা হয়েছে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে এবং কোনো নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমানের মতে, আমাদের সমাজ একটি ট্রানজিশনের মধ্যে আছে। আমরা মডার্ন সোসাইটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। নানা রকমের এফেক্ট আমাদের মনোস্তত্ত্বে এসে পড়ছে। যৌন বিষয়টি আমাদের সমাজে এক সময় হিডেন ছিল, কিন্তু এখন এমন সব উপাদান আসছে যে, আমাদের ট্রেডিশনাল সোসাইটিতে বিকৃতভাবে কাজ করছে। আগে একটা ট্রেডিশনাল সমাজ ছিল, ট্রেডিশনাল চেকআপ ছিল, পরিবারের একটা ভূমিকা ছিল, ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলায় মগ্ন থাকতো। এসব এখন শেষের পথে। প্রযুক্তির উন্নতিতে মানুষ এখন ‘সো কলড’ বিনোদন খুঁজে। কার সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে সেটা ভুলে যাচ্ছে। আগে ছেলে-মেয়েরা প্রেম করলেও তাদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্কের চিন্তা আসতো না, কিন্তু এখন এটা কমন হয়ে গেছে। যৌন বিষয়টি যে কেউ চাইলেই দমন করতে পারে, কিন্তু তা না করে অসহায়ের ওপর আক্রমণ করা হয়। শিশু যেহেতু অসহায় তাই তারা তাদেরকেই বেছে নেয়। এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সমাজের মধ্যে নৈতিক শিক্ষাটা খুব জরুরি। এছাড়া যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত বিচার করলে এবং শাস্তি নিশ্চিত করলে এই ধরনের অপরাধ কমে আসবে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, শিশু ধর্ষণের অন্যতম কারণ- অপরাধীরা ধরা পড়ছে না, ধরা পড়লেও বিচার হচ্ছে না, আবার বিচার হলেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। যারা এই ধরনের অপরাধ করছে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই করছে। ফলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই অন্যরা সতর্ক হবে। সমাজবিজ্ঞানী আরো বলেন, সমাজে এ ধরনের যে ঘটনা ঘটছে, দু-একদিন তা ফলাও করে প্রকাশও করা হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীকালে এ নিয়ে আর কোনো ফলোআপ দেখা যাচ্ছে না। ফলে নিমিষেই নৃশংস এই ঘটনাগুলো আড়ালে চলে যাচ্ছে। অতি সাম্প্রতি দিনাজপুর জেলার পার্বর্তীপুর উপজেলার জমিরহাট তাকিয়াপাড়া গ্রামে পাঁচ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় সারাদেশের মানুষের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে। শিশুটিকে ১৮ ঘণ্টা আটকে ধর্ষণতো করেছেই, এর পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত ও সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে ধর্ষণকারীরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুটি শারীরিক ও মানসিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ৯০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে সবার মানসিকতা গড়ে উঠেনি। নেই বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে জবাবদিহি। তিনি বলেন, দু:খজনক বিষয় হলো, মামলা দায়েরের ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও, সেটা কোনোদিনই হয়নি। এছাড়া ভিকটিমের মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রদানের সময়ও গাফিলতির ঘটনা ঘটে। প্রায়ই দেখা যায় ভিকটিম দুর্বল আর আসামিপক্ষ শক্তিশালী, এ প্রেক্ষিতে অনেক সময় মামলা ধামাচাপা দিতেও দেখা যায়। অপরাধ বিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এ অবস্থা সমাজের চরম অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। মানুষ নৈতিকতার শূন্যের কোঠায় পৌঁছলেই কেবল এমন ঘটনা ঘটাতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট


কোন মন্তব্য নেই