কিশোর অপরাধের ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটি সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তা হলো কিশোর অপরাধ। মানবিক জীবনে কৈশোর কালটি নানা প্রতিকূল প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে পার হয়। স্কুল পেরোনো বয়সটাই হলো উড়– উড়– চঞ্চল মন। বাধা না মানার বয়স। এ বয়সে বন্ধু খুঁজতে থাকে সে, পেয়েও যায়। বন্ধুকে ঘিরে যা সত্য না তাও ভাবতে থাকে। কখনও সে মধুর স্বপ্নে আনন্দে বিভোর থাকে। আবার কখনও বিভিন্ন জটিল সমস্যার কারণে ভিষণœতায় ভোগে। এ ক্রান্তিলগ্নে তার মাঝে এসে ভর করে অস্থিরতা, রোমান্টিসিজম, অ্যাডভারটারিজম ও হিরোইজম। এ সব চিন্তার মাঝে যেমন আছে ভালোলাগা তেমনই আছে নীরব পতনের পদধ্বনি। অর্থাৎ যে সমস্ত কাজ প্রাপ্ত বয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় সে ধরনের প্রচলিত আইন ভঙ্গকারী কাজ অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত হলে সেটিকে কিশোর অপরাধ বলা হয়। কিশোরদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চুরি, হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, পকেটমার, মাদকসেবন, ইভটিজিং ইত্যাদিসহ এমন সব ভয়াবহ অপরাধে কাজ করছে, এমন সব অঘটন ঘটিয়ে চলছে এবং এমন সব লোমহর্ষক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হচ্ছে যা কিনা অকল্পনীয়। বিষয়টি সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানী, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ ও সুশীলসমাজকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সভ্যতার এ চরম উৎকর্ষের যুগে আমাদের আগামী দিনের আশা ভরসার স্থল কিশোর সমাজের এ ব্যাপক বিপর্যয় সত্যিই বড় দুঃখজনক। অসদাচরণ অথবা অপরাধের কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বিচারালয়ে আনীত কিশোরকে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে বলা হয় যে, আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত কিশোররাই হচ্ছে কিশোর অপরাধী। কিন্তু আদালতের অপরাধ নিরূপণ পদ্ধতি ও রায় দেশ ও সমাজ ভেদে বিভিন্ন ধরনের হয়। তাই বলা যেতে পারে যে, কোনো কিশোর অপরাধী কি না তা নির্ভর করে তার মাতাপিতা, প্রতিবেশী সমাজ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সর্বোপরি আদালতের বিচারকের মনোভাবের ওপর।
অপরাধ ও অপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত ১৯৫০ সালের আগস্টে লন্ডনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, শিশু বা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত যেসব আচরণ অসংগতিপূর্ণ বা আইনভঙ্গমূলক অর্থাৎ যা সমাজিকভাবে বাঞ্ছিত বা স্বীকৃত নয় তা সবই কিশোর অপরাধের অন্তর্ভূক্ত। অন্যদিকে আমেরিকান চিল্ড্রেন ব্যুরো কিশোর অপরাধের সংজ্ঞায় উল্লেখ করেছে যে, অপ্রাপ্তবয়স্ক বা কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত রাষ্ট্রীয় আইন বা পৌর বিধি বিরোধী সব কাজই কিশোর অপরাধের আওতাভুক্ত। উপরোন্তু, সমাজ সদস্যদের অধিকারে আঘাত করে এবং কিশোরদের নিজের ও সমাজের কল্যাণের পথে হুমকি স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়, কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত এমন যে কোনো মারাত্মক সমাজবিরোধী কাজও কিশোর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে সমাজ কতৃক আনাকাঙ্খিত আচরণ প্রদর্শনে কিশোদের ব্যর্থতাই কিশোর অপরাধ। পি-ডাব্লু টটাপপান কিশোর অপরাধীদের চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন-
ক. যার বৃত্তি আচরণ, পরিবেশ অথবা সংগীতদল তার নিজস্ব কল্যাণের পথে ক্ষতিকর।
খ. যে অবাধ্য, কিংবা যে তার মাতা-পিতা বা অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
গ. ইচ্ছাকৃতভাবে যে স্কুল পালায় কিংবা সেখানকার নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে এবং
ঘ. যে রাষ্ট্রিয় আইন বা পৌর বিধি বহির্ভূত কাজ করে।
কিশোর অপরাধচিত্রে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালে ইলিশিয়াম ভবনে স্কুল বন্ধুদের দ্বারা দশম শ্রেণীর ছাত্র ঈশা (১৫) হত্যাকান্ডের ঘটে। গ্রেফতার হয় ঈশার বন্ধু প্রিন্সসহ ৫ কিশোর। খুন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কিশোরটি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে নীল ছবি দেখছিল। ঘটনায় দেশবাসী স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। অথচ এ ঈশাই মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তার মাকে বারবার আর্তনাদ করে বলছিল মা তুমি চাকরি ছেড়ে দাও, আমি একা বাসায় থাকতে পারছি না। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক ও নিকট আত্বীয়ের আরও কিছু অবাক করা ঘটনায় দেখা যায়- ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজের তাসনুভা নামে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী আত্মহত্যা করে। বার্ষিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় সে আত্মহত্যা করে বলে কলেজ কর্তৃপক্ষের ধারণা। তার বাড়ি কুষ্টিয়াতে। তাসনুভার বাবা একরাম একজন এনজিও কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সন পর্যন্ত এই ৫ বছরে পুলিশের ডায়েরি মতে, শুধু ঝিনাইদহ জেলায় ৬১ জন শিশু, ১৯১ জন কিশোর ও ৪৩৬ জন কিশোরী অত্মহত্যা করে। কোতোয়ালী থানা পুলিশ পাট গুদাম হাফেজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র নাজমুল হাসান বাবু (১২) হত্যা রহস্য উদঘাটন এবং হত্যার সহিত জড়িত একই মাদ্রাসার ছাত্র হামিদুল ইসলাম (১৪) ও আবদুর রহমান মুন্না নামের অপর এক কিশোরকে গ্রেফতার করেছিলেন। পুলিশ নিহত বাবুর অপহৃত সাইকেল ও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত দা উদ্ধার করেছিলেন। হত্যাকান্ডের অভিযোগে ধৃত কিশোরদের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, নিহত বাবু পাট গুদাম হাফিজিয়া মাদ্রাসা হইতে হেফজ সম্পূর্ণ করায় তাহার পিতা তাহাকে একটি সাইকেল কিনে দেয়। বাবু সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হলে তাহার সহপাঠী কোতয়ালী থানার চর নিকলিয়ার হামিদুল ইসলাম চালানোর জন্য বাবুর কাছ থেকে সাইকেলটি চায়। বাবু সাইকেল না দেয়ায় উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বাবু হামিদুলকে চপেটাঘাত করে। হামিদুল তাহার বন্ধু কোতয়ালী থানার মড়াখোলার আবদুল জলিলের পুত্র আবদুর রহমান ওরফে মুন্নাকে ঘটনা অবহিত করে এবং এঘটনায় বাবুকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাত সাড়ে আটটায় তারা এক বাড়িতে কোরআন খতমের দাওয়াতের কথা বলিয়া একই সাইকেলে ৩ জন রওনা হয়। পথিমধ্যে পাওয়ার হাউজের দেয়ালের পার্শ্বে হামিদুল অতর্কিত বাবুকে জাপটায় ধরে মাটিতে ফেলে দুইজন মিলে দা দিয়ে তাকে জবাই করে ফেলে রাখে। ঘটনার পর হমিদুল ও মুন্না সাইকেলযোগে চলে যায়। অন্যদিকে পকেটমার আরিফ হোসেন (১৬) বয়সে কিশোর হলেও কাজে সে ভয়ঙ্কর। চার বছরে শতাধিক মোবাইল ফোন সেট চুরির অভিজ্ঞতা আছে তার। সুযোগ পেলে অস্ত্রের মুখে পথবন্দী করেও পথচারীদের ফোন ও টাকা লুটে নেয়। এসব অপরাধে এ পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে চারবার। তবে কিশোর হওয়ার সুবাদেই বারবার ছাড়া পেয়ে যায়। আরিফ ও তার সহযোগী কিশোর অপরাধী রাজ্জাক মূলত বাস বা জনবহুল স্থানে পকেট মারে। প্রতিপক্ষ তাদের থেকে দুর্বল হলে তখন পকেটমার থেকে তারা ছিনতাইকারীতে পরিণত হয়, তাদের টার্গেট মূলত জনসাধারণের পকেটে থাকা মোবাইল সেট ও মানিব্যাগ। পকেটমার হিসেবে দুজনই খুব দক্ষ। পকেট কেটে এ পর্যন্ত এক থেকে দেড়শটি মোবাইল ছিনতাই করেছে। ছিনতাইকৃত মোবাইল বিক্রি করে গুলিস্তান স্টেডিয়াম মার্কেটের বিভিন্ন দোনগুলোতে। তবে বয়সে ছোট হওয়ার কারণে ন্যায্যমূল্য পায় না তারা। এ পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে আরিফ চারবার পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। তবে বয়স কম থাকায় প্রতিবারই সে বেরিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসাসহ জীবনধারনের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা। তাছাড়া দেশে বিদ্যমান আছে অনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৩৩। কিন্তু সংবিধান, আইন সব কিছুই নাগরিকগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে অদ্যাবধি অসমর্থ। অসংখ্য সবমেহের এর আত্মদান তারই প্রমাণবহ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য যে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করেন, তা শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। বাস্তবতার সাথে তার কোনো মিল থাকে না। আর এসব বাস্তবতা আমাদের সমাজে বাড়িয়ে দিচ্ছে দুর্নীতি এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধ। দুর্নীতি, অপরাধের সে থাবা ছাড়ছে না আমাদের কিশোরদেরও। এমতাবস্থায়, কঠোর যন্ত্রণা নিবৃত্তির জন্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরী বাধ্য হয়ে যদি দুষ্কর্মে বা পাপাচারে লিপ্ত হয় তাহলে তাকে কতখানি দোষারোপ করা যায় তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
সুতরাং, দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনধারনের মৌলিক উপকরণসমূহ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে জাতীয়ভিত্তিক সর্মসূচি নিতে হবে। এ দায়িত্ব পরিবার প্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্র প্রধান পর্যন্ত সবার। এ লক্ষ্যে সামাজিক ন্যায় বিচারের স্বার্থে সম্পদের সুষম বণ্টনসহ বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে অতি দরিদ্র ও দুস্থদের জন্যে আর্থিক নিরাপত্তামূলক সুযোগ সুবিধাদির ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের জন্যে বিশেষ করে অনগ্রসর অঞ্চল ও জনগোষ্টীর জীবনযাত্রার মান গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে সবার আগে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা ছাড়া দারিদ্র্য দূর করার কোনো উপায় নেই। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনোমানুষই অপরাধী হয়ে জন্মায় না। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নানাবিধ কারণে আবেগ ও পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাবে মানুষ অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং কিশোর অপরাধীরা পেশাদার অপরাধীদের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হচ্ছে তা অনুনন্ধানপূর্বক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। এজন্য সবার আগে দরকার গ্রাম কিংবা শহর, পাড়া কিংবা মহল্লায় সর্বত্র ভালো পরিবেশ বজায় রাখতে শিক্ষিত সজ্জন ও অভিভাবক শ্রেণীর সম্মিলিত প্রয়াস। অধ্যায়ন, সৃজনশীলতা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা জরুরী। পরিবার, সমাজ ও স্কুলের পরিবেশ হওয়া দরকার আনন্দময় ও প্রণোদনাপূর্ণ। একটু ভালোবাসার কাঙাল এ শিশুদের সুযোগ দেয়া হলে এরাই একদিন দেশের সম্পদে পরিণত হতে পারে। দরিদ্র মাতা-পিতার ঘরে জন্ম নেয়াই কি এদের অপরাধ ? জন্ম অপরাধে এদের সাথীরা যাচ্ছে স্কুলে আর এদের বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে ঝুলে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত কাটিয়ে সামান্য পারিশ্রমিক নিয়ে ঘরে ফেরা। এ ধরনের হাড়ভাঙা শ্রমের কাজ থেকে এদের সরিয়ে নিয়ে হালকা কাজ দিয়ে লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়ার কী কেউ নেই?


কোন মন্তব্য নেই